এক সময় লোকমুখে প্রচলিত বদনাম ছিল। এখন দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম নদীবন্দরের এ বদনাম নেই। সদরঘাটকে নান্দনিকভাবে সাজিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। কমেছে ইজারাদার, হকার এবং কুলিদের দৌরাত্ম্য। নিশ্চিত করা হয়েছে যাত্রী নিরাপত্তা।
যাত্রীরা বলছেন, আগে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ছিল ঘিঞ্জি এবং নোংরা। এখন পুরো টার্মিনালে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। নেই হকারদের হাঁকডাক, কুলিদের ব্যাগ টানাটানি। স্বাচ্ছন্দ্যে লঞ্চে যাতায়াত করছেন যাত্রীরা। তাই বলা যায়, সদরঘাট এখন ফিটফাট।
বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, অব্যবস্থাপনায় যাত্রীদের পদে পদে ভোগান্তি ছিল সদরঘাটে। বছরখানেক আগে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। এখন এখানে আন্তর্জাতিক মানের টার্মিনালের সেবা পাচ্ছেন যাত্রীরা। এ অবস্থা ধরে রাখতে ৩২টি ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা দিয়ে সবসময় নজরদারি করা হচ্ছে। এমন যাত্রীবান্ধব পরিবেশে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন তারা। এছাড়া টিকিট পেতে এখন আর সরাসরি লঞ্চে যেতে হয় না। নির্দিষ্ট স্থানে কাউন্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনলাইনে মিলছে সুন্দরবন, গ্রিনলাইনসহ বিভিন্ন লঞ্চের টিকিট।
পুরান ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ফটক থেকে বরাবর দক্ষিণে সদরঘাট টার্মিনাল। সরেজমিনে দেখা যায়, টার্মিনালের কোনো ফটকের সামনে হকার নেই। ফুটপাতে সারিবদ্ধভাবে মাটি এবং টবে লাগানো হয়েছে বাগানবিলাস, কৃষ্ণচূড়া, মাধবিলতা, পাতাবাহারি গাছ। ফুটেছে নানান রঙের ফুল।
ঘাটে প্রতিটি ফটকে রয়েছে কাউন্টার। সেখানে প্রবেশ ফি দিয়ে ঘাটে ঢুকছেন যাত্রীরা। মালামাল বহন নিয়ে কুলিদের মধ্যে টানা-হেঁচড়া নেই। ভবনের ভেতর এবং মূল টার্মিনালে পন্টুন অনেকটা সুনসানই। জ্বলছে নানা রঙের বাতি। সেখানেও হকারের হাঁকডাক নেই। লঞ্চে যাত্রী ওঠাতে চালক-শ্রমিকদের ডাকাডাকি নেই। যার যে লঞ্চ পছন্দ, সেটিতে উঠছেন। আবার বিভিন্ন জেলা থেকে আসা যাত্রীরা অনেকটা নির্বিঘ্নেই লঞ্চ থেকে নেমে যে যার গন্তব্যে যাচ্ছেন।
বরিশালে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য সুন্দরবন-১১ লঞ্চে উঠেছেন আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, দেড় বছর পর এই টার্মিনাল ব্যবহার করছি। সদরঘাটের পরিচ্ছন্নতা ও পন্টুনের হকার না দেখে বেশ অবাক হয়েছি। এই পরিবেশ যেন বদলে না যায়, বন্দর কর্তৃপক্ষকে তা তদারকি করতে হবে।
টার্মিনাল ভবন-১ ও টার্মিনাল ভবন-২ এর নিচতলায় তিনটি শৌচাগার বেশ পরিচ্ছন্ন। এ দুটি ভবনের নিচতলায় শিশুকে বুকের দুধ পান করানোর কক্ষ করা হয়েছে। পৃথক কক্ষে যাত্রীদের বসার জন্য রয়েছে কাচের ঘর। এর ভেতর রয়েছে এলইডি টিভি, বৈদ্যুতিক পাখা। কক্ষটি থেকে পন্টুনে থাকা সারিসারি লঞ্চ এবং বুড়িগঙ্গা নদীর পরিবেশ দেখা যায়।
টার্মিনাল ভবন-২ এর দ্বিতীয় তলায়ও রয়েছে প্রায় এক হাজার যাত্রী বসার ব্যবস্থা। এই কক্ষে বসে মোবাইল ফোন চার্জ দিচ্ছিলেন পটুয়াখালীর তন্ময় রানা। তিনি জানান, লঞ্চে মোবাইল ফোন চার্জ দেয়ার ব্যবস্থা নেই। তাই টার্মিনালে মোবাইলে চার্জ দিচ্ছেন তিনি।
আগে পুরোনো টার্মিনাল ভবনের ভেতর নদী পাড়ে বিভিন্ন ধরনের প্রায় ২৬টি দোকান ছিল। বছর দুয়েক আগে টার্মিনালের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য এসব দোকান ভেঙে দেয়া হয়েছে। এখন নদীতীরে হরেক রকমের ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে সবকটিতে ফুলও ফুটেছে। এছাড়া পুরোনো টার্মিনালের পূর্ব এবং পশ্চিম পাশে টিন শেডের শতাধিক অবৈধ আড়ৎ ছিল। সে জায়গাও খালি করা হয়েছে।
এখন টার্মিনালের পূর্ব অংশে গাড়ি পার্কিং, ছোট্ট পার্ক এবং নদীর ভেতর পন্টুনের ব্যবস্থা করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে শ্যামবাজারের লালকুঠি অংশে গ্রিনলাইন পরিবহনের (লঞ্চ) জন্য আলাদা পন্টুন রয়েছে। সেখানেও হকার নেই। অনেকটাই নিরিবিলি পরিবেশ। পশ্চিম দিকে আহসান মঞ্জিল পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীতীরে হরেক রকমের গাছ লাগানো হয়েছে। তবে সদরঘাট থেকে গুলিস্তানের দিকে আসার সড়কে যানজটের ভোগান্তির চিত্র এখনো বদলায়নি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা নদীবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. গুলজার আলী বলেন, দেশের ২২টি জেলায় চলাচলের অন্যতম মাধ্যম সদরঘাট নৌবন্দর। এখন এ ঘাটের সীমানা বাদামতলী থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। টার্মিনালে উন্নতমানের ৩০টি পন্টুন স্থাপন করা হয়েছে। শিগগির আরও কয়েকটি পন্টুন যোগ হবে। এছাড়া নৌকাডুবি প্রতিরোধে নিরাপদ দূরত্বে আলাদা আলাদা নদীর ঘাট গড়ে তোলা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এখন সদরঘাটে কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। যাত্রী অভিযোগ নেই বললেই চলে। তারপরও পুরো টার্মিনাল নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কোথাও কোনো অব্যবস্থাপনা পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
Leave a Reply