সব জল্পনা–কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আজ মঙ্গলবার (০৯ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলবে ভোট গ্রহণ। এরপর শুরু হবে গণনা প্রক্রিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী ব্যালটের মাধ্যমে নির্ধারণ করবেন তাঁদের প্রতিনিধি।
৬ বছরের অপেক্ষার পর এবার হচ্ছে ডাকসুর ৩৮তম নির্বাচন। এর আগে সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৯ সালে, যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল দীর্ঘ ২৮ বছর পর। এবারের নির্বাচনে ডাকসুর ২৮টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৭০ জন প্রার্থী। একই সঙ্গে ১৮টি হল সংসদের ২৩৪টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ হাজার ১০৮ জন। মোট ভোটার সংখ্যা ৩৯ হাজার ৮৭৪। ভোটগ্রহণ হবে ৮টি কেন্দ্রে স্থাপিত ৮১০টি বুথে।
লড়াইয়ের আভাস
ভিপি ও জিএস পদে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। সহসভাপতির পদে তিন প্রার্থী আলোচনায় আছেন সবচেয়ে বেশি—জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের আবিদুল ইসলাম খান, ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের সাদিক কায়েম এবং স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্যের প্রার্থী উমামা ফাতেমা। ভোটারদের অনেকে মনে করছেন, শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যারা সরব ছিলেন, তারাই এগিয়ে থাকবেন।
উৎসবের আমেজে ঢাবি
সোমবার (০৮ সেপ্টেম্বর) থেকেই পুরো ক্যাম্পাসে ছিল নির্বাচনী আমেজ। ডাকসু ভবন ও মধুর ক্যানটিনের সামনে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রচারণার সময় শেষ হওয়ায় প্রার্থীরা সরাসরি প্রচারে অংশ নেননি, তবে অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা সংবাদ সম্মেলনও করেছেন।
অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব ও ভোটারদের ভূমিকা
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ৫৭ শতাংশ ছাত্রী ও ৩৪ শতাংশ ছাত্র ক্যাম্পাসের বাইরে থাকেন। এই অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নির্বাচনের ফলাফলে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। তবে বিশেষ করে অনাবাসিক নারী শিক্ষার্থীদের ভোট দেওয়ার আগ্রহ নিয়ে কিছুটা শঙ্কা আছে। ছাত্রী হলগুলোতে জোরেশোরে প্রচারণা চালানোয় ভোটে অংশগ্রহণ বাড়বে বলে আশাবাদী প্রার্থীরা। তাঁদের ধারণা, যদি ভোট কাস্টিং ৯০ শতাংশ ছাড়ায়, তবে নির্বাচনের সমীকরণ পাল্টে যাবে।
আশা–আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা
রোকেয়া হলের শিক্ষার্থী শামিম আরা আক্তার বলেন, “শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়ে যোগ্য প্রার্থী বেছে নেবে। আমরা চাই, ডাকসু নির্বাচিত প্রতিনিধি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কার্যকর ভূমিকা রাখুক।” তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর নিয়মিত নির্বাচন হলে শিক্ষার্থীদের আশা–আকাঙ্ক্ষা সংসদে প্রতিফলিত হবে।
আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা
ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে প্রশাসন ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ক্যাম্পাসের ৮টি প্রবেশপথে সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তাঁদের সঙ্গে আছেন বিএনসিসি ও রোভার স্কাউট। ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী জানান, পুরো নির্বাচন সিসি ক্যামেরায় মনিটর করা হবে। ক্যাম্পাসে প্রায় ২ হাজার পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্য মোতায়েন থাকবেন।
ডিএমপির নির্দেশনা অনুযায়ী, সোমবার রাত ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের অস্ত্র বহন করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথও গতকাল রাত থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে, যা বুধবার সকাল পর্যন্ত চলবে। বৈধ পরিচয়পত্রধারী শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা–কর্মচারী ও সাংবাদিকরা প্রবেশ করতে পারবেন।
বিশেষ ব্যবস্থা ও শাটল সার্ভিস
শিক্ষার্থীদের নির্বিঘ্নে ভোট দিতে শাটল সার্ভিস চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আজ সকাল ৭টা ৪৫ মিনিট থেকে বিকাল ৩টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত চলবে এই বিশেষ সেবা। এছাড়া মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন আজ দিনভর বন্ধ রাখবে। বিকল্প হিসেবে শাহবাগ ও সচিবালয় স্টেশন ব্যবহার করতে পারবেন শিক্ষার্থীরা।
ভোট প্রদানের সময় শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইডি কার্ড, হল আইডি, গ্রন্থাগার কার্ড বা পে–স্লিপ (প্রথম বর্ষের জন্য) ব্যবহার করতে পারবেন। এ ছাড়া অনলাইনে ভোটার যাচাইয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ ব্যবস্থা রেখেছে।
উপাচার্যের আহ্বান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান শিক্ষার্থীদের নির্ভয়ে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “ডাকসু তোমরা চেয়েছ, গভীরভাবে প্রত্যাশা করেছ। গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য এটি জরুরি। সারা দেশ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তোমরা দায়িত্বশীলভাবে ভোট দেবে, আমরা তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছি।”
বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় বাড়তি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে উপাচার্য আশ্বস্ত করেন।
চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য অপেক্ষা
আজকের ভোট শেষে প্রতিটি কেন্দ্রে ফলাফল প্রকাশ করা হবে। পরে নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রীয়ভাবে পূর্ণাঙ্গ ফলাফল ঘোষণা করবে। সব মিলিয়ে চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হতে পারে মধ্যরাত পর্যন্ত।
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা অনেক। ইতিহাসের সাক্ষী এই নির্বাচনের মাধ্যমে গড়ে উঠতে পারে নতুন নেতৃত্ব, যা বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও এগিয়ে নেবে বলে আশাবাদী সবাই।










