রবিবার | ৯ নভেম্বর, ২০২৫ | ২৪ কার্তিক, ১৪৩২ | ১৭ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭

আবু সাঈদকে হত্যার আদালতে বিবরণ দিলেন সাক্ষী আয়ান

নিজস্ব প্রতিবেদক

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে হত্যার ঘটনায় পুলিশ কতটা আক্রমণাত্মক ছিল, সেই বিবরণ উঠে এসেছে কলেজছাত্র মো. সিয়াম আহসান আয়ানের সাক্ষ্যে।

আরসিসিআই পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র আয়ান রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবু সাঈদ হত্যা মামলায় নিজের জবানবন্দি উপস্থাপন করেন।

১৮ বছর বয়সী আয়ান এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি এ মামলার ৬ নম্বর সাক্ষী।

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই রাতে রংপুরে একটি সভায় তারা সিদ্ধান্ত নেন, পরদিন ১৬ জুলাই বেলা ১২টায় রংপুর জিলা স্কুলের সামনে একত্রিত হয়ে তারা রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে গিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দেবেন।

সে অনুযায়ী ১৬ তারিখ দুপুরে তারা রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগিয়ে যান। পথে রংপুর পুলিশ লাইনসের সামনে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে তারা আবার একত্রিত হয়ে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যান।

বেলা আনুমানিক ২টা ১০ মিনিটের দিকে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের সামনে অবস্থান করছিলেন। সিয়াম ছিলেন মিছিলের মাঝামাঝি।

ওই সময় রংপুর মহানগর পুলিশের ডিসি (ক্রাইম) আবু মারুফ হোসেন, এডিসি (ডিবি) শাহানুর আলম পাটোয়ারী, এসি আরিফুজ্জামান, ওসি (তাজহাট) রবিউল ইসলাম, এসআই বিভূতী ভূষণ রায়, এএসআই আমির হোসেন এবং কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়সহ পুলিশ বাহিনীর আরও ৪০/৫০ জন এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া, সাধারণ সম্পাদক শামীম মাহফুজ, সাংগঠনিক সম্পাদক ধনঞ্জয় কুমার টগর, দপ্তর সম্পাদক বাবুল হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এমরান চৌধুরী আকাশসহ আক্তার হোসেন, ইসহাক, মাসুদুল হাসান, ফজলে রাব্বী, সেজান আহমেদ আরিফসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের ‘ক্যাডার বাহিনী’ মিছিলে হামলা চালায় বলে সাক্ষ্যে তুলে ধরেন সিয়াম।

তিনি বলেন, পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করলে এর প্রতিবাদে আবু সাঈদ রাস্তার আইল্যান্ডের পশ্চিম পাশে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেইট বরাবর দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যান।

“পুলিশ বাহিনী থেকে তাকে শুট করা হয়। তখন আমি বিয়াম শপিং কমপ্লেক্সের সামনে রাস্তার পূর্ব পাশে অবস্থান করছিলাম। সেখান থেকে আমি আবু সাঈদকে দেখতে পারছিলাম। গুলি খেয়ে আবু সাঈদ তার ব্যালেন্স হারিয়ে আইল্যান্ডের পূর্বপাশে চলে আসে।”

তখন সময় বেলা আনুমানিক ২ট ১৭ মিনিট বলে জানান সিয়াম।

তিনি বলেন, “আমি আবু সাঈদ ভাইকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসি। তখন তাকে আমি তুলে আমার ডানপাশে অর্থাৎ পূর্ব পাশে ঘুরিয়ে নেই। পুলিশের পক্ষ থেকে আবারও গুলি করা হয় এবং সেই গুলিতে আমি আহত হই। আমার বাম পাশের পুরো শরীর গুলিবিদ্ধ হয়।”

এই পর্যায়ে সাক্ষী সিয়াম ট্রাইব্যুনালে তার শরীরের বাঁ পাশে গুলির ক্ষতচিহ্ন দেখান।

এ সময় ট্রাইব্যুনালে বস্তু প্রদর্শনী হিসেবে আবু সাঈদকে গুলির ঘটনার ভিডিও দেখানো হয়। সাক্ষী সিয়াম আবু সাঈদের পাশে তার হাত ধরে থাকা ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে শনাক্ত করেন।

সিয়াম বলেন, “আবু সাঈদ ভাই আবারও ব্যালেন্স হারিয়ে আমার হাত থেকে পড়ে যায়। তখন তার শরীরের সামনের পাশে প্রচণ্ড পরিমাণ রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। সাথে থাকা আন্দোলনকারী ও বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক মিডিয়ার মাধ্যমে আরও জানতে পারি এসি আরিফুজ্জামানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম এসে আবু সাঈদ ও তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত আন্দোলনকারীদের উপর লাঠিচার্জ করে এবং আবু সাঈদের মাথার পিছনে আঘাত করে।”

এরপর সিয়াম আবু সাঈদকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাস্তার উত্তর পাশে পার্কের মোড়ের দিকে এগিয়ে যান এবং সেসময় আরও কিছু আন্দোলনকারী এসে আবু সাঈদকে সরিয়ে নিয়ে যান।

“তারপর তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি তখন তৎকালীন পার্কের মোড়, বর্তমান আবু সাঈদ চত্বরে অবস্থান করি।”

পরে তারা আবু সাঈদের মৃত্যুর খবর জানতে পারেন বলে জানান সিয়াম।

সিয়ামের অভিযোগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, উপাচার্য হাসিবুর রশিদ, প্রক্টর শরীফুল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান, সহকারী অধ্যাপক মশিউর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা রাফিউল, আপেল, আমুসহ আরও অনেকে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং পুলিশ প্রশাসনসহ অনেকে হামলাকারীদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে।

তিনি এই মামলার সুষ্ঠু বিচার এবং সকল আসামির ফাঁসি চান।

আবু সাঈদের বুক পেতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার ওই ভিডিও ও ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক দফা দাবিতে গড়ায়।

ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র- জনতার বিক্ষোভের মুখে ওই বছরের ৫ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান।

গত ২৪ জুন আবু সাঈদ হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা। ৩০ জুন মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়।

এরপর ৬ অগাস্ট ৩০ আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

এ মামলায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যসহ ২৬ জন এখনও পলাতক। তাদের পক্ষে গত ২২ জুলাই সরকারি খরচে চারজন আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

আপনার মন্তব্য

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

অনুসরন করুন

সর্বশেষ খবর

আর্কাইভ

  • Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
     12
    3456789
    10111213141516
    17181920212223
    24252627282930